বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১১ ১৪৩১   ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

 কুষ্টিয়ার  বার্তা
২৩০

মিরপুরে পুতুলনাচের ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছেন কুদ্দুস

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২০ অক্টোবর ২০১৯  

ছোট একটি ঘর। তার ভেতর বসে আছে রাজা, রানি, বাদশা থেকে শুরু করে বাঘ, হরিণ ও সাপ। তবে এদের কারও প্রাণ নেই। এদের প্রাণ দেন আবদুস কুদ্দুস। প্রাণ বলতে গল্প–গানের সঙ্গে তাদের চরিত্র ফুটিয়ে তোলেন। তাতেই আনন্দ পায় গ্রামবাংলার মানুষ। এটাকে বলে পুতুলনাচ।

গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য পুতুলনাচের কারিগর কুদ্দুসের বাড়ি কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার ফুলবাড়িয়া ইউনিয়নের নওদাপাড়া গ্রামে। বাড়ির সদস্যদেরও পুতুলনাচের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছেন। এতেই তাঁর সংসার চলে।

জানা যায়, কুদ্দুস নিজেই বাড়িতে পুতুল তৈরি করেন। রংও করেন। পোশাক তৈরিতে সাহায্য করেন তাঁর মেয়ে। মেয়ের ছোট সন্তানেরা নানাকে বাদ্যযন্ত্র বাজাতে সহায়তা করে। 

কুদ্দুস জানান, কাঠ, সোলা দিয়ে পুতুল তৈরি করা হয়। সেটাতে রংতুলির আঁচড় দিয়ে বিভিন্ন বর্ণিল সাজে সাজানো হয়। কাপড়ের পোশাক পরানো হয়। পরে পুতুলের সঙ্গে সুতা বেঁধে বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হেলিয়ে দুলিয়ে তাদের নাচানো হয়। তবে ডিজিটাল সংস্কৃতি আসায় পুতুলনাচের কদর কমে গেছে।

কুদ্দুসের পুতুলনাচের দলের নাম ‘মনহারা’। মাসে একটি ডাক পান। সেটাও দূরের কোনো জেলা বা কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে। তা থেকে যা আয় হয়, তা দিয়েই সংসার চলে যায়।

১৯৭২ সাল থেকে তিনি এই মনহারা পুতুলনাচ দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এর আগে ১৯৬৫ সালে যখন কুদ্দুসের বয়স ১০ বছর, তখন তাঁর বাবা তাঁকে এলাকায় গানের আসরে নিয়ে যেতেন। একদিন তাঁকে পুতুলনাচের দল মনহারার শুকচান নামের এক ওস্তাদের কাছে নিয়ে যানতাঁর বাবা। সেখানে কয়েক মাস পুতুলনাচের বিভিন্ন গান শেখেন। পড়ালেখা জানা নেই। শুনে শুনেই আত্মস্থ করেন তিনি। কখনো শাড়ি পরে পুতুলের সঙ্গে নাচ ও গান করতেন। এতে ওস্তাদের নজরে পড়েন তিনি। প্রায় ১৬ বছর পুতুলনাচের আসরে পুতুলের সঙ্গে মেয়ে সেজে গান করেছেন।

১৯৭২ সালে এই মনহারা পুতুলনাচের দলের দায়িত্ব পান। একদিন শুকচান অসুস্থ হয়ে মারা যান। সে সময় দলে দুর্দিন নেমে আসে। ‘মনহারা’ পুতুলনাচে ১৪ সদস্য ছিলেন। এর মধ্যে ১০ জন গানের তালে পুতুলকে পরিচালনা করতেন। বাকিরা বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন আর গাইতেন। ১৯৭৫ সালে হারমোনিয়াম বাজানোর প্রশিক্ষণ নেন। ধীরে ধীরে দলের দুর্দিন কাটিয়ে ওঠেন। একটা অনুষ্ঠানে গেলে আরেকটি অনুষ্ঠানের দাওয়াত পেতে থাকেন। বেশ ভালোই চলছিল পুতুলনাচের দল। 

কুষ্টিয়াসহ বেশ কিছু অঞ্চলে পুতুলনাচ দেখিয়ে বেশ সুনাম অর্জন করেন। কুষ্টিয়া ছাড়াও বিভিন্ন জেলায় রাজকন্যা মনিক মালা, সীতার বনবাস, রূপবান, গরিবের ছেলে, গরিবের মেয়ে, হিংসার পরিণামসহ বিভিন্ন পালা করেছেন। একেকটি পালায় সময় লাগে দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত। ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমিতেও দল পরিচালনা করেছেন।

পুতুলনাচের রাজা, রানি, বাদশা, উজির–নাজিরসহ সাপ, নৌকামাঝি, কুমার, মাছ, বাঘ, হুনুমান, হরিণ, ঘোড়া বিষয় নিয়ে গ্রাম্য জীবনভিত্তিক হাসিঠাট্টা ও তামাশামূলক গল্পে রচিত পুতুলনাচ দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবেশন করেছেন।

মনহারা পুতুলনাচের সবচেয়ে জনপ্রিয় সোনার জাদু ও রূপবান। এছাড়া সাগরভাসা, ফেরারি সম্রাট, নাচমহল, ভিখারির ছেলে অন্যতম পালা। ২০০৭ সালে ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমিতে পুতুলনাচ প্রতিযোগিতায় সারা দেশের ৪৮টি পুতুলনাচের দলের মধ্যে প্রথম হন। ২০১৩ ও ২০১৬ সালে পুরস্কারও পান।

কুদ্দুসের আক্ষেপ, আগের মতো পুতুলনাচ আর কেউ দেখেন না। দলটিকে খুব কষ্টে টিকিয়ে রেখেছেন। পুতুলগুলো ভালোভাবে সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

 কুষ্টিয়ার  বার্তা
 কুষ্টিয়ার  বার্তা
এই বিভাগের আরো খবর