বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৩ ১৪৩১  

সৈয়দ আশরাফকে নিয়ে কিছু স্মৃতি, কিছু কথা

নিউজ ডেস্ক

দৈনিক কুষ্টিয়া

প্রকাশিত : ১২:১০ পিএম, ১৩ জানুয়ারি ২০১৯ রোববার

সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হতো। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের তদানীন্তন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জিল্লুর রহমানের বাসায় অনুষ্ঠিত প্রতিটি মিটিংয়ে তিনি আসতেন আর আমিও সেখানে উপস্থিত থাকতাম। সে সময়ের দলীয় সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল অন্তরীণ থাকায় আশরাফ ভাই তখন দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

এ অবস্থায় ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে দলের একটি প্রেসিডিয়াম সভা শেষে সবাই যখন মিটিং রুম থেকে উঠে ড্রইং রুমে আসতে থাকলেন, তখন সেখানে ডাক্তার দীপু মনি, আখতারুজ্জামান এবং আমি বসা ছিলাম। তো, প্রেসিডিয়াম সদস্যরা যেতে উদ্যত হলে আশরাফ ভাই বললেন, ‘এবারে ১৫ আগস্ট পালনের জন্য তার কাছে ফান্ড নেই।’

এ কথা শুনে প্রেসিডিয়াম সদস্যরা একে একে সবাই চলে গেলে আশরাফ ভাই কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে তিনিও চলে গেলেন। আমরা তিনজন গুটিসুটি হয়ে তখনও এক কোণে দাঁড়িয়ে আছি।

অতঃপর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাহেবের প্রস্তাবে এবং আখতার ভাইয়ের সমর্থনে একজনের কাছ থেকে কিছু অর্থের ব্যবস্থা হলে পরদিন জিল্লুর রহমান সাহেব তার বাসার কর্মচারী রঞ্জনকে দিয়ে ফোন করিয়ে আশরাফ ভাইকে ডেকে সেই অর্থ হস্তান্তর করেন।

 

আওয়ামী লীগের সেদিনের দুর্দিনে আশরাফ ভাই এবং জিল্লুর রহমান সাহেব এভাবে দলীয় কর্মকাণ্ড অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন। সেসব ঘটনার মূল নায়ক একে একে দু’জনই চলে গেলেন। এ চলে যাওয়া চিরন্তন হলেও আশরাফ ভাই বোধহয় একটু আগেই চলে গেলেন।

বয়সে আশরাফ ভাই আমার চেয়ে মাত্র এক মাসের ছোট এবং সেই হিসাবে আমরা একদম সমবয়সী। আর আমার মতো সমবয়সীদের অনেককে রেখেই তিনি অসময়ে চলে গেলেন। যদিও কে কার আগে যাবেন, তা আমাদের জানাও নেই, হাতেও নেই। সবকিছু মহান আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে।

তবুও বলব, আশরাফ ভাই আমাদেরকে এবং তার প্রিয় দলকে রেখে একটু আগেভাগেই যেন চলে গেলেন। তার মতো পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ দলের ও সরকারের নেতৃস্থানীয় পদে আরও কিছুদিন আসীন থাকলে তরুণ প্রজন্মের নেতাকর্মীরা তাকে দেখে সৎ, সাহসী ও পরিচ্ছন্ন থাকার অনুপ্রেরণা পেতেন।

তিনি যখন মন্ত্রী হয়ে বেইলি রোডের সরকারি বাসভবনে ওঠেন, সেখানে তার সঙ্গে আমার কয়েকবার দেখা হয়েছিল। মনে পড়ে একবার কথায় কথায় তিনি বলেছিলেন, ‘আপনাদের মতো লোকদের রাজনীতিতে মূল্যায়ন হওয়া উচিত।’

আমি তখন দলের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহসম্পাদক এবং পাবনা জেলা কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য। তিনি আমাকে কেন্দ্রে একটি ছোটখাটো পদ প্রদানেরও আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী কাউন্সিলে তিনি নিজেই দলীয় সাধারণ সম্পাদকের পদ ত্যাগ করায় সেসব আর হয়ে ওঠেনি।

যাক সে কথা। আশরাফ ভাইকে যতটা দেখেছি, শুনেছি এবং তার সঙ্গে কথা বলে যা বুঝেছি তাতে তার নীতি ও বিশ্বাসমতে, ‘রাজনীতি করা মানে টাকার খনির সন্ধান করা নয় বা টাকার খনিতে বসার চেষ্টা করা নয়।’ তার মতে, রাজনীতির মাধ্যমে অর্থ কামিয়ে যারা ধনশালী হচ্ছেন, তারা রাজনীতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। রাজনৈতিক অঙ্গনের বিশিষ্ট এ ব্যক্তিকে তাই সবসময়ই একজন নির্লোভ, নিরহংকারী, পরিচ্ছন্ন মানুষ হিসেবে দেখে এসেছি।

একবার তার বাসভবনে দেখা করতে গেলে নিচতলায় বসা তার পিএ জানালেন, তিনি উপরে বিশ্রামে আছেন। সে অবস্থায় তার পলিটিক্যাল পিএ, নাম সম্ভবত সেলিম, তার সঙ্গে বসে প্রায় এক ঘণ্টা কথা বলে যা শুনলাম, তা রীতিমতো চমকপ্রদ।

জানলাম কোনো অন্যায়, অবৈধ বা নিয়মাচারবহির্ভূত কোনো কাজই তাকে দিয়ে কেউ করাতে পারেন না। আর এ জন্য অনেকে তাকে অপছন্দও করেন। কিন্তু সেসব তিনি মোটেও আমলে নেন না। সঠিক ও সুন্দরের পথে পদচারণাই ছিল তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

এই আশরাফ ভাইয়ের বাসভবনে আরও একদিন গিয়ে দেখতে পেলাম, তিনি গভীর মনোনিবেশ সহকারে ল্যাপটপে কাজ করে চলেছেন। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, অনেক সময় লাগবে, অন্য একদিন এলে খানিকক্ষণ কথা বলবেন। কিন্তু তারপর আর কোনোদিনই আশরাফ ভাইয়ের বাসায় যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কারণ আমাকেও কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। অতঃপর তার সঙ্গে দেখা হয়েছে পার্টি অফিসে।

ধানমণ্ডির পার্টি অফিসে গেলে অথবা চলাফেরায় কুশল বিনিময় হয়েছে মাত্র। বাকি জীবনে সেই সুযোগটুকুও চলে গেল। আশরাফ ভাই আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন। চলে গেলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের সূর্যসৈনিক সৈয়দ নজরুল ইসলামের পুত্র। চলে গেলেন অসীম সাহসী ও ত্যাগী একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমরা তাকে চিরতরে হারালাম। হারালাম একজন দেশপ্রেমিক ও সৎ রাজনীতিককে।

তার মতো সৎ, দেশপ্রেমিক আর ক’জন আছে জানি না, তবে সে সংখ্যা যে খুব বেশি নয়, তা বলাই বাহুল্য। আজ এ মুহূর্তে তাই আমাদের সবাইকেই দৃঢ়চিত্তে শপথ নিতে হবে- আমরাও তার মতো সৎ, সহজ-সরল ও দেশপ্রেমিক হব। আর সরলতায়, ত্যাগে, সততায় তার আদর্শ ধারণ করতে পারলে তবেই দেশের রাজনীতি থেকে সব কপটতা, কদর্যতা, কলুষতা দূর হবে। তার প্রতি, তার আত্মার প্রতি সম্মান দেখাতে হলে তাই আমাদের সবাইকেই ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে সততার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে রাজনীতিকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে হবে।

মনে রাখতে হবে, রাজনীতি থেকে আশরাফ ভাই টাকাকড়ি, ধন-সম্পদ কিছুই আহরণ করেননি। তিনি সৎভাবে রাজনীতি করে গেছেন। রাজনীতির মাধ্যমে তিনি কোনো টেন্ডারবাজি করেননি, কোনো উৎস থেকে টাকা-পয়সা গ্রহণ বা অর্জন করেননি। তাই অর্থ-কড়ির ক্ষেত্রে তিনি প্রায় খালি হাতেই থেকেছেন। আর যাওয়ার সময়ও তিনি খালি হাতেই গেছেন। যে কারণে তার অন্তর্ধানের পর তার প্রতি মানুষের এত বেশি শ্রদ্ধা, মানুষের মুখে তার এত বেশি প্রশংসা।

এমন একজন সজ্জন ব্যক্তির মরদেহ গত রোববার শেষ বিকালে যখন বনানী কবরস্থানে পৌঁছল, সেখানে তখন লোকে লোকারণ্য। অনেকের চোখেই পানি। ভিড় ঠেলে তার কবরে একমুঠো মাটি দিয়ে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলাম, ‘এই মহৎ ব্যক্তির আত্মাকে শান্তি দিন।’ আমিন।