বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৪ ১৪৩০  

বাইডেনের ঐক্যের বার্তা ও বাংলাদেশ

নিউজ ডেস্ক:

কুষ্টিয়ার বার্তা

প্রকাশিত : ০৮:১১ পিএম, ১৪ নভেম্বর ২০২০ শনিবার

ওবামা সরকারের সময় ২০১৪ সালে সপ্তাহব্যাপী সফরকালে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহ-সভাপতিত্ব ২৬ সেপ্টেম্বর শান্তিরক্ষা সম্মেলনে মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে এবং রুয়ান্ডার রাষ্ট্রপতি পল কাগমে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অবদানের কথা তুলে ধরেছিলেন। এদিক থেকে আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শেখ হাসিনাকে ভালো করেই চেনেন ও জানেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ভাইস-প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিসকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।

জো বাইডেন সাবেক রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার সঙ্গে ৪৭তম ভাইস-প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ওই পদে দায়িত্ব পালন করেন। বারাক ওবামা ২০০৮ সালে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

তিনি ২০১২ সালে ফের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। শেখ হাসিনা সরকার ও বারাক ওবামার প্রশাসনের একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ ঘটে। বাংলাদেশ সম্পর্কে ওবামা প্রশাসনের ইতিবাচক ধারণা ছিল সবসময়।

বারাক ওবামা এ দেশের মোবাইল ব্যাংকিং নিয়ে ২০১৫ সালে প্রশংসা করেন। শেখ হাসিনা সরকারের অগ্রগতিতে সন্তুষ্ট হয়ে এ দেশকে তিনি এশিয়ার টাইগার আখ্যা দেন।ওবামা সরকারের সময় ২০১৪ সালে সপ্তাহব্যাপী সফরকালে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহ-সভাপতিত্ব ২৬ সেপ্টেম্বর শান্তিরক্ষা সম্মেলনে মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে এবং রুয়ান্ডার রাষ্ট্রপতি পল কাগমে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অবদানের কথা তুলে ধরেছিলেন। এদিক থেকে আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শেখ হাসিনাকে ভালো করেই চেনেন ও জানেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে ৫৩৮টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের অন্তত ২৭০টি পেতে হয়। সেখানে জো বাইডেন পেয়েছেন ২৭৩টি। অপরদিকে ট্রাম্প পেয়েছেন ২১৪টি। এ হিসাবে ‘সবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রত্যয়’ ঘোষণাকারী ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন।

উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল নির্ভর করে মোট ৫৩৮ জন ‘ইলেক্টর’ বা নির্বাচকের ভোটের ওপর। প্রতিটি রাজ্যের জনসংখ্যার ভিত্তিতে এসব নির্বাচকের সংখ্যা নির্ধারিত থাকে। যেমন, জনবহুল ক্যালিফোর্নিয়ার রয়েছে ৫৫ জন নির্বাচক, আবার বিরল জনসংখ্যার মন্টানার রয়েছে মাত্র ৩টি ভোট। একটি রাজ্যে সবচেয়ে বেশি ‘জনপ্রিয় ভোট’ যিনি পাবেন, সে রাজ্যের নির্ধারিত সব ইলেক্টোরাল ভোট তার খাতায়ই জমা হবে। এ কারণে মোট ভোটের হিসাবে এগিয়ে থেকেও কোনো প্রার্থী পর্যাপ্ত ইলেক্টোরাল ভোট পেতে ব্যর্থ হলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন না।

৭ নভেম্বর পেনসিলভেইনিয়া রাজ্যের ভোটের ফলাফলে প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ইলেকটোরাল ভোট নিশ্চিত হওয়ার পরপরই টুইট করে বাইডেন বলেছেন, ‘আমেরিকা, মহান এই রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আমাকে বেছে নেওয়ায় আমি সম্মানিত। আমাদের সামনে যে কাজ রয়েছে, তা কঠিন হবে। তবে এই প্রতিশ্রুতি আমি আপনাদের দিচ্ছি, আপনি আমাকে ভোট দিন বা না দিন, আমি হব সব আমেরিকানের প্রেসিডেন্ট। আমার ওপর যে আস্থা আপনারা রেখেছেন, তার প্রতিদান আমি দেব।’

অন্যদিকে বাইডেনের রানিং মেট কামালা হ্যারিস প্রথম নারী, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ এবং প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস-প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।

ভোট জালিয়াতি বা অবৈধভাবে ভোট দেওয়ার কোনো প্রমাণ না থাকায় বিতর্কহীন ছিল এই নির্বাচন। প্রধান দুই প্রার্থীর একেকজনের ভোট ৭ কোটির বেশি। ডাকযোগে দেওয়া ভোট সম্পর্কে অভিযোগ এনে হার স্বীকারে ট্রাম্প নারাজ হলেও শেষ পর্যন্ত গণরায়ে তাকে ক্ষমতার মসনদ থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছে। ট্রাম্পকে গোয়ার্তুমি ছাড়তে এবং বাস্তব পরিস্থিতি বোঝাতে সক্ষম হয়েছে জনগণ। অন্যদিকে জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রবাসীকে আহ্বান জানিয়েছেন ঐক্যবদ্ধ হয়ে তার পেছনে দাঁড়াতে; বলেছেন, ভোট ঘিরে তিক্ততা ভুলে সামনের দিকে তাকাতে।

‘কঠিন একটা নির্বাচনের পরও উত্তেজনা চলছে। তবে আমি বলব, রাগ-বিরাগ পেছনে ফেলে রাখতে। আমাদের সামনে বড় সমস্যা, এখন দলাদলির সময় নয়। আর আমরা প্রতিপক্ষ হতে পারি, তবে পরস্পরের শত্রু নই।’

গণতন্ত্র রক্ষার জন্য শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর একটি বিশেষ দিক। ট্রাম্পের উপদেষ্টা ল্যারি কাডলো সেটি ভালোভাবে হবে বলেই মনে করেন। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশ। সেখানে সবাই আইনের শাসন মেনে চলেন। আর তাই সাবেক প্রেসিডেন্টও তা মানবেন। তারা মনে করেন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে জনগণের আস্থা টিকিয়ে রাখা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের অন্যতম দায়িত্ব।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকা বিখ্যাত। ‘প্রতিটি মানুষই সমান এবং একই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি’ এই বাক্যকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার বাণী রচিত হয়েছে। আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বিভিন্ন দেশের আরও অনেক সমশ্রেণির দলিল প্রণয়নে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে এবং এর ধারণাসমূহ পরবর্তী সময়ে ক্যারিবিয়ান, স্প্যানিশ আমেরিকা, বলকান, পশ্চিম আফ্রিকা, মধ্য ইউরোপসহ অন্যান্য দেশে ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত অনুসৃত হয়।

অন্যদিকে আমেরিকার ইতিহাস থেকে বিশ্বের অনেক দেশ নিজেদের শুধরে নিতে সক্ষম হয়েছে। ১৮৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন দাস প্রথা বাতিল করেন, ১৮৭০ সালে কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকার এবং ১৯২০ সালে নারীদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়। ১৯৫০ সালের দিকে কালো লোকদের ভাল স্কুলে যাওয়ার, ভাল রেস্টুরেন্টে খাওয়ার ও বাসে বসার অধিকার ছিল না। মার্টিন লুথার কিংয়ের আন্দোলনের ফলে তারা সব অধিকার লাভ করে।

এসব ঘটনা বিশ্ববাসীকে মানুষের মর্যাদা রক্ষার জন্য অনুপ্রাণিত করেছে।মনে রাখতে হবে- ব্রিটিশদের কাছ থেকে শুধু ভৌগোলিক স্বাধীনতা নয়, অষ্টাদশ শতাব্দীতে উৎপাটিত হয়েছিল সব পরাধীনতার শৃঙ্খল, বহাল হয়েছিল বাকস্বাধীনতা, পত্রিকা ও প্রকাশনার স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, এমনকি কোনো আইন পরিবর্তনের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করার স্বাধীনতা পেয়েছিল সবাই, আমেরিকায় বসবাসকারী প্রতিটি মানুষ। অর্থাৎ নিজেকে প্রকাশ করার যে স্বাধীনতা, সংবাদপত্র, রেডিও-টেলিভিশন তথা গোটা মিডিয়ার যে স্বাধীনতা তাও স্বীকৃতি পায়। সেদিন ব্যক্তি জেনেছিল ধর্ম পালনে রাষ্ট্র কাউকে বাধ্য বা নিষেধও করবে না। যে যার ধর্ম পালন করবে। সেদিন থেকে এখনো নিরাপদে ও নিশ্চিন্তে স্বাধীনভাবে নিজের ধর্ম পালনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র শান্তির ভূমি। প্রায় আড়াই’শ বছর ধরে নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষ সেখানে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে চলেছে।

এই দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের এখন সুসম্পর্ক। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। সেই সঙ্গে সহায়তার জন্য ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদান করে। সেসময় অবকাঠামোগত উন্নয়নেও সহায়তা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। শেখ হাসিনার শাসনামলে আমেরিকার অন্যতম প্রধান মিত্রে পরিণত হয় বাংলাদেশ। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা, জঙ্গিবাদ বিরোধী ও জলবায়ু পরিবর্তন প্রসঙ্গে এ দুই রাষ্ট্র বেশকিছু সহায়তামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ওবামা প্রশাসনের আন্তর্জাতিক উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য উন্নয়ন এবং পরিবেশ উন্নয়নমূলক অনেক কাজে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান সহযোগী ছিল।

২০১২ সালে রাষ্ট্রদ্বয়ের মধ্যে একটি কৌশলগত চুক্তি হয়। যুক্তরাষ্ট্র চলতি বছর আগস্ট মাসে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এজন্য প্রতি তিন থেকে চার মাস পর ‘ট্রেড এন্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফোরাম এগ্রিমেন্ট (টিকফা)’ এর ইন্টারসেশনাল সভা করার প্রস্তাব দিয়েছে।ওই সভায় যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের স্থগিতকৃত জিএসপি সুবিধা ফের চালুর বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, পূর্বে ঘোষিত বিভিন্ন দেশের জন্য মার্কিন জিএসপি সুবিধা প্রদান প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ডিসেম্বরে। পরর্বতী প্রকল্প চালু হলে বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা প্রদানের বিষয় বিবেচনা করার সুযোগ আছে।

শেখ হাসিনা সরকার মনে করে, জো বাইডেনের সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তৈরি পোশাক, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, হেলথ প্রডাক্ট রপ্তানি, করোনাকালে তৈরি পোশাকের ক্রয় আদেশ বাতিল না করে ভ্যাকসিনসহ অন্যান্য মেডিকেল সামগ্রী উৎপাদন, বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, শিল্প কারখানা বাংলাদেশে রিলোকেশন, কারিগরি সহযোগিতা বৃদ্ধিসহ বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানের তৈরি পণ্য সহজে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির বিষয়ে মার্কিন সরকারের সহযোগিতা পাবে।

তবে দু’দেশের মধ্যে গত ১১ বছর ধরে সব সহযোগিতামূলক কার্যক্রমই পরিচালিত হচ্ছে। কারণ এদেশে গণতন্ত্র আছে, আর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে এদেশের অবস্থান বিশ্বব্যাপী অভিনন্দিত। ২০১৬ সালেও বাংলাদেশ এশিয়ার মধ্যে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের পর সবচেয়ে বেশি মার্কিন সহায়তা লাভ করেছে।

ভরসা এখন নতুন প্রেসিডেন্টের ওপর। জয়ী হয়ে জো বাইডেন নিজেকে এমন এক নেতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন যিনি অনৈক্য নয় বরং করোনা মহামারি এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক অশান্তির মধ্যে পতিত নিজের দেশ ও বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করবেন বলেছেন। তার বক্তব্যের এই স্পিরিট বাংলাদেশকে একসঙ্গে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করেছে।

লেখক: ড. মিল্টন বিশ্বাস; লেখক, কবি, কলামিস্ট; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।