শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৪ ১৪৩০   ১৯ রমজান ১৪৪৫

 কুষ্টিয়ার  বার্তা
২৩৭৭

পৃথিবীর ‘জ্বলন্ত পাহাড়’

প্রকাশিত: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮  

আগ্নেয়গিরি- প্রকৃতির অনিন্দ্য ও ভয়ানক এক নিদর্শন। পৃথিবীতে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত নিত্যদিনের ঘটনা। পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আগ্নেয়গিরি। প্রতিদিনই কোনো না কোনো আগ্নেয়গিরি থেকে ঘটছে অগ্ন্যুৎপাত। ইন্দোনেশিয়ার বালির মাউন্ট আগুং, আইসল্যান্ডের বার্ডারবুঙ্গা, হাওয়াই দ্বীপের কিলোয়া, মেক্সিকোর কলিমা- এ আগ্নেয়গিরিগুলো প্রচণ্ড সক্রিয় ও আমাদের কাছে বেশ পরিচিত।

 

তবে শুধুমাত্র আমাদের পৃথিবীতেই নয়, গোটা সৌরজগত জুড়েই রয়েছে আগ্নেয়গিরির বিস্তরণ! বৃহস্পতির চাঁদ ‘লো’-এর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, উপগ্রহটিতে মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে আগ্নেয়গিরি রয়েছে। এ আগ্নেয়গিরিগুলো তার তলদেশ থেকে সালফার সমৃদ্ধ লাভা উৎসারণ করে প্রতিনিয়ত। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে কোনো গ্রহের তলদেশের পদার্থসমূহ তার পৃষ্ঠে চলে আসে এবং পৃষ্ঠের যাবতীয় বস্তু তলদেশে চলে যায়। ধারণা করা হয়, এভাবেই লক্ষ লক্ষ বছর পর পর কোনো গ্রহ বা উপগ্রহ আগ্নেয়গিরির প্রতিনিয়ত অগ্নুৎপাতের ফলাফল হিসেবে আক্ষরিক অর্থেই উল্টে যায়।

1.পৃথিবীর ‘জ্বলন্ত পাহাড়’

অন্যদিকে শনির উপগ্রহ ইনকেলাডাসেরও রয়েছে আগ্নেয়গিরি সদৃশ্য উষ্ণ প্রসবণ। তবে পৃথিবী ও লো এর মতো সেগুলো গলিত প্রস্তর উৎসারণ করে না। সেই আগ্নেয়গিরিগুলো দিয়ে নিঃসৃত হয় কর্দমাক্ত বরফ আকৃতির কেলাস। বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন সৌরজগতের দূরতম গ্রহগুলো এরকম আরো বরফের আগ্নেয়গিরি বা ক্রায়োভলকানো সমৃদ্ধ। পৃথিবীর খুব কাছাকাছি অবস্থিত শুক্র গ্রহেও রয়েছে বহু সক্রিয় আগ্নেয়গিরি, অতীতে মঙ্গল গ্রহেও আগ্নেয়গিরির লাভা নিঃসরণের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। এমনকি সূর্যের সবচেয়ে কাছাকাছি অবস্থিত গ্রহ বুধেও এর জন্মলগ্নের শুরুতে আগ্নেয়গিরি অগ্ন্যুৎপাতের নিদর্শন রয়েছে।

মহাদেশ ও দ্বীপ দেশ তৈরিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে আগ্নেয়গিরি। সমুদ্র তলদেশের সুবিশাল পর্বত ও আশ্চর্যজনক সব গর্ত তৈরিতেও রয়েছে আগ্নেয়গিরির অবদান। পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠে লাভা ও অন্যান্য পদার্থ নিঃসরণ করে আগ্নেয়গিরিগুলো ভূ-পৃষ্ঠের গঠন উপাদান নির্ধারণ করে। আমাদের পৃথিবী তার জন্ম লগ্নে ছিলো আগ্নেয়গিরিময় একটি গ্রহ। চারিদিকে তখন শুধু লাভার সমুদ্র ছিলো।

তবে সৃষ্টির আদিতে যেসব আগ্নেয়গিরির অস্তিত্ব ছিলো, তার অনেকগুলোই এখন সক্রিয় নেই। অধিকাংশই দীর্ঘদিন যাবৎ মৃত অবস্থায় পড়ে আছে, অদূর ভবিষ্যতে জাগার কোনো সম্ভাবনাও নেই। অন্যদিকে কিছু কিছু আগ্নেয়গিরি রয়েছে যাদেরকে বলা হয় সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। এগুলোর ভবিষ্যতে কোনো না কোনো সময়ে আবার সক্রিয় হবার সম্ভাবনা রয়েছে।

 

2.পৃথিবীর ‘জ্বলন্ত পাহাড়’

এবার আসা যাক আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে অগ্নুৎপাত প্রসঙ্গে। অনেকেই ১৯৮০ সালে হওয়া আমেরিকার ওয়াশিংটন রাজ্যের সেন্ট হেলেনস আগ্নেয়গিরির সেই বিখ্যাত অগ্নুৎপাত সম্পর্কে জানেন। তা এমনই ভয়ানক ছিলো, পর্বতটির একটি অংশ রীতিমতো উড়ে যায় এবং আশেপাশের রাজ্যগুলোতেও লক্ষ লক্ষ টন ছাই বৃষ্টির মতো ছড়িয়ে পড়ে। সেন্ট হেলেন্স ছাড়াও ওই এলাকায় রয়েছে মাউন্ট ক্যালডেরা, মাউন্ট হুড ও মাউন্ট রেইনারের মতো সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। ভূ-পৃষ্ঠের তলদেশে প্লেটের নাড়াচাড়ার ফলে এসব আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ঘটে বলে ধারণা করা হয়।

 

পৃথিবীর ঊষালগ্নে প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে ছিল বহু সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। সেগুলো থেকে নিঃসরিত লাভা সমুদ্রের তল পৃষ্ঠে আস্তে আস্তে জমে সমুদ্র মধ্যে দ্বীপের মতো কাঠামো গঠন করতো। বিশাল হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ এভাবেই আগ্নেয়গিরির শিলা দ্বারা তৈরি হয়েছে! এখনো জাপান থেকে নিউজিল্যান্ড সমগ্র প্রশান্ত মহাসাগরীয় অববাহিকার বিশেষ বিশেষ জায়গায় সক্রিয় আগ্নেয়গিরির সন্ধান মেলে। এ অঞ্চল বিশেষকে নামকরণ করা হয়েছে 'রিং অফ ফায়ার'।

ইউরোপের অন্যতম প্রধান সক্রিয় আগ্নেয়গিরি হলো সিসিলির মাউন্ট এটনা। এছাড়া ঐতিহাসিক ভিসুভিয়াস তো রয়েছেই। ৭৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এ আগ্নেয়গিরির লাভার স্রোতে চাপা পড়েই চিরতরে ধ্বংস হয়ে যায় অভিশপ্ত পম্পেই ও হারকুলেনিয়াম নগরী। এখনো মাঝে মাঝেই এ আগ্নেয়গিরির প্রভাব এর চারপাশের অঞ্চলে ভূমিকম্প হয়, দফায় দফায় অগ্নুৎপাত তো রয়েছেই!

3.পৃথিবীর ‘জ্বলন্ত পাহাড়’

মজার ব্যাপার হলো সব আগ্নেয়গিরি যে পর্বতের মত গঠন তৈরি করবে তেমনটি নয়। অনেক শায়িত আগ্নেয়গিরিও রয়েছে, বিশেষ করে যেগুলো সমুদ্র মধ্যে অবস্থিত। এগুলোকে বলে ভেন্ট ভলকানো। ভেন্ট ভলকানো সবচেয়ে বেশি দেখা যায় শুক্র গ্রহে। পৃথিবীতে নানাভাবে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ঘটে থাকে।

 

আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে পৃথিবীর অভ্যন্তরের বিভিন্ন পদার্থ ভূপৃষ্ঠে আসার পথ খুঁজে পায়। পৃথিবীর বুকে থাকা আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত হয় মূলত ভূ-পৃষ্ঠের অভ্যন্তরে ম্যান্টল নামক স্তর থেকে। ভূ-পৃষ্ঠের অভ্যন্তরে গলিত শিলাগুলোকে বলা হয় ম্যাগমা। যখন ম্যান্টল স্তরে পর্যাপ্ত পরিমাণে ম্যাগমা জমা হয় তখন যথেষ্ট চাপের কারণে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত শুরু হয়। অনেক আগ্নেয়গিরিতে অগ্নুৎপাতের সময় গলিত ম্যাগমা ভূ-অভ্যন্তর থেকে একটি সেন্ট্রাল টিউব ধরে এগিয়ে উপরে ছিটকে আসে। এই সেন্ট্রাল টিউবটিকে বলা হয় আগ্নেয়গিরির 'গ্রীবা'। গ্রীবাটি আগ্নেয়গিরির চূড়ায় এসে উন্মুক্ত হয়।

অন্যান্য আগ্নেয়গিরিগুলোতে ভেন্ট বা ফাটলের মধ্য দিয়ে লাভা, ছাই ও গ্যাস নির্গত হয়। এগুলো পরবর্তীতে কোণাকার পর্বত তৈরি করতে পারে। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের আগবেয়গিরিগুলোর অগ্ন্যুৎপাত এমন হয়।

4.পৃথিবীর ‘জ্বলন্ত পাহাড়’

ভূপৃষ্ঠের অভ্যন্তরে অনেক গভীরে রয়েছে বিশাল সব টেকটোনিক প্লেট। এই প্লেটগুলো অনবরত নড়াচড়া করছে এবং একটি অপরটিকে ধাক্কা দিচ্ছে। যখন দুইটি টেকটোনিক প্লেটের মধ্যে সংঘর্ষ হয় তখন এদের গলিত ম্যাগমা অগ্নুৎপাত এর মাধ্যমে বাইরে চলে আসে। প্যাসিফিক রিমের আগ্নেয়গিরিগুলো এভাবেই তৈরি হয়েছে, যেখানে দুইটি প্লেট একটি অপরটির উপর দিয়ে যাবার সময় প্রচণ্ড ঘর্ষণ ও তাপ উৎপন্ন হয় যা গলিত লাভাকে বাইরে বেরিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করে।

গভীর সাগরের আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে যে লাভা নির্গত হয় তাতেও কিন্তু থাকে ম্যাগমা ও বিভিন্ন পদের গ্যাস। সমুদ্রের গভীরে হওয়ায় আমরা অধিকাংশ সময়েই সে অগ্নুৎপাত দেখতে পাই না কিন্তু অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সৃষ্ট প্রস্তর মেঘ (ক্লাউডস অফ পিউমিস) চোখে পড়ে। এই প্রস্তর মেঘ ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়ে দীর্ঘ রক রিভার্স বা প্রস্তর স্রোতধারা তৈরি করে। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ এভাবেই তৈরি হয়েছে। হাওয়াইয়ের দ্য বিগ আইল্যান্ড ক্লাউডস অফ পিউমিস-এর ফলে তৈরি হওয়া সর্বশেষ দ্বীপ। এছাড়াও সাগরতলের আগ্নেয়গিরির লাভা জমে আরো একটি দ্বীপ তৈরি হচ্ছে যা এখনো প্রশান্ত মহাসাগরে পানির নিচে অবস্থান করছে, তার নাম দেয়া হয়েছে লইহি।

 কুষ্টিয়ার  বার্তা
 কুষ্টিয়ার  বার্তা