শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৪ ১৪৩০   ১৯ রমজান ১৪৪৫

 কুষ্টিয়ার  বার্তা
৭৭২

সিজার ও সার্জারী সংক্রান্ত আধুনিক মাসয়ালা

প্রকাশিত: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮  

এক. ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। মানব জীবনের অতীব প্রয়োজনীয় বিষয় চিকিৎসা। তাই এই বিষয় ইসলামের নির্দেশনার বাহিরে থাকবে, তা হতে পারে না। ইসলাম চিকিৎসা শাস্ত্র শিখা, শিখানো ও এর প্রয়োগকে শুধু বৈধই বলেনি, বরং রোগ থেকে আত্মরক্ষা ও সুস্থতার জন্য একে ফরজে কেফায়া সাব্যস্ত করেছে। (আহকামুল জারাহাতি তিব্যিয়া:৭৭)

দুই. মানুষের দেহ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাটা-ছেড়া করা হারাম, তবে প্রয়োজনে ফকীহগণ অপারেশন করার বৈধতা দিয়েছেন। (আহকামুল জারাহাতি তিব্যিয়া:৮৯)

মাসয়ালা: অপারেশন করার মানে হলো, মানুষের দেহ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাটা-ছেড়া করা; এর দ্বারা কোনো কোনো সময় অসুস্থ ব্যক্তির মৃত্য বা অঙ্গহানী হয়। এ জন্য, ফকীহগণ অপারেশনের বৈধতার জন্য আটটি শর্তে উল্লেখ করেন; যা পাওয়া গেলে অপারেশন করা বৈধ হবে, অন্যথায় নয়। সেই ৮টি শর্ত হলো (এক) অপারেশন বৈধ ও জায়েজ হওয়া, অর্থাৎ যে সকল অপারেশনকে শরীয়ত নাজায়েজ বলেছে তা না হওয়া। যেমন বার্ধক্যজনিত চিন্থ দূর করার জন্য অপারেশন করা। (দুই) অসুস্থ ব্যক্তি অপারেশনের মুখাপেক্ষী হওয়া যেমন অপারেশন না করা হলে মৃত্য বা অঙ্গহানীর আশংকা থাকা। (তিন) অসুস্থ ব্যক্তির অনুমতি থাকা। (চার) সার্জন ও তার সহযোগীদের মাঝে অপারেশন করার যোগ্যতা থাকা। (পাঁচ) সার্জনের প্রবল ধারণা থাকা যে, সে অপারেশনে সফল হবে। (ছয়) অপারেশনের পরিবর্তে এমন কোনো চিকিৎসা না থাকা, যা ক্ষতির দিক থেকে অপারেশনের চেয়ে হালকা। (সাত) অপারেশনের কারণে এমন কোনো রোগ বা সমস্যা সৃষ্টি না হওয়া যা ক্ষতির দিক থেকে বর্তমানের তুলনায় বেশি। (আট) অপারেশন ফলপ্রসু হওয়া।

 

মাসয়ালা: অভিজ্ঞ কোনো সার্জনের যদি প্রবল ধারণা হয় যে, অপারেশন করলে রোগী মারা যাবে তাহলে উক্ত সূরতে অপারেশন করা হারাম।

মাসয়ালা: রোগী যদি অনুমতি দেয়ার উপযুক্ত না হয় তাহলে তার পক্ষ হতে অভিভাবকের অনুমতিই যথেষ্ঠ।

মাসয়ালা সার্জনের পরিপূর্ণ যোগ্যতার জন্য তার ভেতর দুটি গুণ থাকতে হবে। (১) যে অপারেশন সে করতে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকা। (২) ওই জ্ঞান প্রয়োগ করে, উত্তমভাবে অপারেশন সম্পন্ন করতে সক্ষম হওয়া।

মাসয়ালা: সার্জন যোগ্য হওয়া সত্তেও কোনো কারণে যদি অপারেশন সফল না হয় এবং এর দ্বারা রোগীর কোনো ক্ষতি হয় অথবা ইনফেকশন হয়ে রোগ অন্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে সার্জনের ওপর এর দায় চাপানো যাবে না।

মাসয়ালা: যে রোগের কারণে অপারেশন করা হচ্ছে, অপারেশন করার দ্বারা তার চেয়ে বড় কোনো সমস্যা হলে, অপারেশন করা ও করানো উভয়টা হারাম। কেননা, ফিকহী বিধান হলো, ‘কোনো সমস্যাকে তার চেয়ে ছোট সমস্যা দিয়ে দূর করা’ অর্থাৎ কোনো ছোট সমস্যাকে দূর করতে গিয়ে, তারচেয়ে বড় সমস্যায় পড়তে হলে, তা বৈধ নয়।

মাসয়ালা: যে রোগের কারণে অপারেশন করা হচ্ছে, অপারেশন করার দ্বারা তার চেয়ে ছোট কোনো সমস্যা হলে, অপারেশন করা ও করানো উভয়টা জায়েজ। কেননা, ফিকহী বিধান হলো, ‘কোনো ব্যক্তি দুটি সমস্যায় পতিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে এবং ছোট সমস্যায় লিপ্ত হয়ে বড়টাকে দফা করা সম্ভব হলে, ছোটটাকে গ্রহণ করে বড়টাকে দফা করা।’

বৈধ ও অবৈধ হওয়ার দিক থেকে অপারেশন:

ছয় প্রকারের অপারেশন জায়েজ এবং কখনো কখনো অপারেশন করা শরীয়তের দৃষ্টিতেও জরুরি বটে। তবে এখানে অপারেশন জায়েজের পাঁচ সূরত নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে-

এক. রোগের চিকিৎসা হিসেবে অপারেশন করা; কখনো কখনো রোগের চিকিৎসা হিসেবে অপারেশন করা শরীয়তের দৃষ্টিতে জরুরি আর কখনো কখনো শুধুমাত্র বৈধ। এই দিক থেকে তা দুই ধরণের হতে পারে- (ক) অতীব প্রয়োজনে চিকিৎসা হিসেবে অপারেশন করা। যেমন- রোগের কারণে রোগীর অবস্থা এত অবনতি হয়েছে যে, অপারেশন করা না হলে রোগী মারা যাবে, এরুপ অবস্থায় রোগীকে বাঁচানোর জন্য অপারেশন করা ফরজ-আবশ্যক। শরীয়তের পরিভাষায় এ রকম অপারেশনকে বলা হয়, ‘আল জারাহাতুল ইলাজিয়্যাতুজ জরুরীয়্যাহ’। (খ) তুলনামূলকভাবে প্রথম সূরতের চেয়ে হালকা প্রয়োজনে রোগের চিকিৎসা হিসেবে অপারেশন করা। যেমন- রোগের কারণে রোগীর মারা যাওয়ার বা রোগ বেড়ে যাওয়ার আশংকা হওয়া। এ রকম রোগ দূর করার জন্য যে অপারেশন করা হয়, শরীয়তের পরিভাষায় তাকে বলা হয়, ‘আল জারাহাতুল ইলাজিয়্যাতুল হাজিয়া’। এর আবার দুটি প্রকার আছে- এক. রোগ এমন যে, এর দ্বারা রোগীর অনেক ক্ষতি হচ্ছে, চাই এই ক্ষতি সাময়িক হোক বা সার্বক্ষণিক। দুই. রোগ এমন যে, অপারেশন করা না হলে রোগীর তাৎক্ষণিক কোনো ক্ষতি হবে না, কিন্তু ভবিষ্যতে ক্ষতির আশংকা আছে। যেমন- অপারেশন না হলে এই রোগ অন্য কোনো অঙ্গে ইনফেকশন হয়ে ওই অঙ্গকে পঙ্গু বানিয়ে ফেলবে। এই উভয় সুরতেই অপারেশন করা সর্বসম্মতিক্রমে জায়েজ।

কখনো কখনো রোগীর অবস্থা এত মারাত্মক হয় না যে, তার অপারেশন করা (ক) বা (খ) নম্বারের অধিনে পড়ে। কিন্তু এই রোগের অপারেশন না করলে কষ্ট ও পেরেশানিতে থাকতে হবে; এই সুরতেও অপারেশন করা জায়েজ। যেমন- কারো কারো নাকের গোস্ত বেড়ে যায়। তো রোগে রোগী মারা যাওয়ার আশংকা নেই, কিন্তু তা কষ্ট ও পেরেশানির কারণ তাই তা কেটে ফেলা জায়েজ।

দুই. রোগ চিহ্নিত করার জন্য অপারেশন করা। শরীয়তের দৃষ্টিতে এ রকম অপারেশন জায়েজ হওয়ার জন্য শর্ত হলো, এর বিকল্প সহজ কোনো পদ্ধতি না থাকা যেমন- আল্ট্রসোনোগ্রাম বা অন্যান্য পরীক্ষা।

তিন. বাচ্চা মায়ের পেট থেকে বের করে আনার জন্য সিজার করা। সিজার দুটি অবস্থায় হতে পারে: (ক) জরুরি অবস্থায় সিজার করা; জরুরি অবস্থায় সিজার বলতে বুঝানো হয়, মা ও সন্তান উভয়ের বা কোনো একজনের জীবন আশংকার মধ্যে থাকে, সিজার না হলে মা ও সন্তান উভয়েই বা কোনো একজন মারা যাবে। উক্ত অবস্থায় সিজার করতে শরীয়তের দৃষ্টিতে কোনো সমস্যা নেই। (খ) জন্ম দানের স্বাভাবিক পদ্ধতিতে বাচ্চা বের হয়ে আসা অসম্ভব মনে হওয়ার কারণে পেট কেটে বাচ্চা বের করা। এ ধরণের সিজারের শরয়ী হুকুম ডাক্তারের সিদ্ধান্তের ওপর মওকুফ। জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার দ্বারা যদি ডাক্তারের প্রবল ধারণা হয় যে, স্বাভাবিকভাবে বাচ্চা হলে মা প্রসব-যন্ত্রণা সহ্য করতে পারবে না বা এর দ্বারা বাচ্চর ক্ষতি হয়ে যাবে তাহলে উক্ত অবস্থায় সিজার করে বাচ্চা বের করতে শরীয়তের দৃষ্টিকে কোনো সমস্যা নেই। আর যদি জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার দ্বারা ডাক্তারের প্রবল ধারণা হয় যে, স্বাভাবিকভাবে বাচ্চা হলে মা ও সন্তানের কোনো ক্ষতি হবে না তাহলে সিজার করা জায়েজ হবে না।

চার. খতনার উদ্দেশ্যে বিশেষ অঙ্গের চামড়া কাটা। হানাফী মাজহাব মতে খতনা করা সুন্নত। তাই খতনার জন্য চামড়া কাটা শুধু জায়েজই নয় বরং সুন্নতও।

পাঁচ. চিকিৎসা শাস্ত্র শেখার উদ্দেশ্যে সার্জারি করা। এটা সাধারণত মৃত প্রাণী বা লাশের ওপর করা হয়। এ রকম সার্জারি জায়েজ হওয়া না হওয়ার ব্যাপারে ফকীহদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে। প্রথম মত হলো, ডাক্তারি শেখার জন্য মৃত লাশ কাটা-ছেড়া করা জায়েজ। এই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন আরব বিশ্বের কয়েকটি ফিকহী বোর্ড যেমন হাইয়াতু কিবারিল উলামা বিল মামলাকাতিল আরাবিয়্যতিস সৌদিয়া, লাজনাতুল ইফতা জর্দান, মাজমাউল ফিকহিল ইসলামী মক্কা মোর্কারমা, লাজনাতুল ইফতা মিশর। দ্বিতীয় মত হলো, চিকিৎসা শাস্ত্র শেখার উদ্দেশ্যে লাশের ওপর সার্জারি করা জায়েজ নেই। এই মতের পক্ষে রয়েছেন প্রসিদ্ধ ফকীহ শায়েখ মুহাম্মাদ বুখাইত আল মুতী ও শায়েখ মুহাম্মাদ বুরহান উদ্দীন আস সাম্বলী।

মাসয়ালা: ফৌজদারি পোস্টমর্টেম (অর্থাৎ হত্যাকারী চিহ্নিত করার জন্য যে পোস্টমর্টেম করা হয়), রোগ চিহ্নিত করার জন্য পোস্টমর্টেম (অর্থাৎ যা মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করার জন্য করা হয় যে, ব্যক্তি কোনো ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলো কিনা! এমনটি হলে অন্যদেরকে হেফাজতের ব্যবস্থা নিতে হবে)। এই দুই প্রকারের ব্যাপারে সৌদি আরবের বড় বড় আলেমগণের ফতোয়া হলো তা জায়েজ।

বেহুশ করার বিধান: শরয়ী কোনো ভিত্তি ছাড়া এমনিতেই বেহুশ করা শরীয়তের দৃষ্টিতে হারাম। কারণ, এর দ্বারা সাময়িকভাবে মানুষের আকল-বুদ্ধি লোপ পেয়ে যায় যেমনটি মদ গাঁজা ইত্যাদি দ্বারা লোপ পায়। তবে কয়েকটা সুরতে বেহুশ করা জায়েজ। নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো-

এক. জরুরতের সময়; রোগীর অবস্থা এমন যে, বেহুশ করা ছাড়া অপারেশন করা সম্ভব নয় বরং বেহুশ করা ছাড়া অপারেশন করা হলে রোগী মরে যাওয়ার আশংকা প্রবল। যেমন- হার্টের অপারেশন বা তার মতো আরো যত ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন রয়েছে। এ সকল ক্ষেত্রে রোগীকে বেহুশ করতে কোনো সমস্যা নেই।

দুই. হাজত বা প্রয়োজনের সময়; রোগীকে বেহুশ করা ছাড়া অপারেশন অসম্ভব নয় এবং এতে রোগীর মৃত্যুরও ঝুঁকি নেই কিন্তু হুশে রেখে অপারেশন করা হলে রোগীর সাধ্যতিত কষ্ট করতে হবে। এই সুরতেও অপারেশনের সময় বেহুশ করা জায়েজ।

তিন. জরুরত ও হাজতের পর্যায় থেকেও কম প্রয়োজনের সময়; বেহুশ করা ছাড়া অপারেশন সম্ভব এবং কষ্টও সহ্য করার মতো, তারপরও রোগীর ওপর অপারেশনকে আসান বা কষ্টহীন করার জন্য উক্ত সুরতে বেহুশ করা জায়েজ। এর বাহিরে একেবারে হালকা কষ্ট থেকে বাঁচার জন্য বেহুশ করা জায়েজ হবে না।

মাসয়ালা: নাপাক জানোয়ারের কোনো অঙ্গ দ্বারা উপকৃত হওয়া বা এর কোনো অঙ্গ মানুষের কোনো স্থানে স্থাপন করা বৈধ নয়। তবে জরুরতের সময় কোনো পাক জানোয়ারের অঙ্গ না পাওয়া গেলে তার অঙ্গ লাগানো বৈধ হবে।

মূল: মাওলানা হুযাইফা বুসতানবী হাফিজাহুল্লাহু

 কুষ্টিয়ার  বার্তা
 কুষ্টিয়ার  বার্তা
এই বিভাগের আরো খবর